খাগড়াছড়ি জেলা পরিচিতি।

খাগড়াছড়ি জেলা, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম ঐতিহাসিক এবং পর্যটন বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি জেলা, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মিশ্রণে বৈচিত্র্যময় রূপে প্রতিষ্ঠিত। এই জেলার প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, দর্শনীয় স্থানসমূহ, মুক্তিযুদ্ধে অবদান এবং প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বদের অবদান খাগড়াছড়িকে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশে পরিণত করেছে।
খাগড়াছড়ি জেলার পটভূমি
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত খাগড়াছড়ি কখনো ত্রিপুরা রাজন্যবর্গ, কখনো বা আরাকান রাজ্যের অধীনে শাসিত ছিল। ত্রিপুরা রাজাগণ ৫৯০ থেকে ৯৫৩ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামসহ (খাগড়াছড়ি) এই অঞ্চল শাসন করতেন। এরপর ব্রিটিশরা ১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম এবং ১৭৮৫ সালে ত্রিপুরা রাজ্যের কবল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে। ব্রিটিশদের অধীনে ১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম তখন কাপ্তাই (রাঙ্গামাটি), বান্দরবান, এবং খাগড়াছড়ি নামে তিনটি মহকুমায় বিভক্ত ছিল। ১৯৬৮ সালে খাগড়াছড়িকে থানায় উন্নীত করা হয় এবং ৭ নভেম্বর ১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়িকে পৃথক জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
খাগড়াছড়ি জেলার নামকরণ
খাগড়াছড়ির প্রাচীন নাম ছিল ‘তারক।’ খাগড়াছড়ি নামের উৎপত্তি হয়েছে নল খাগড়ার বন থেকে। খাগড়াছড়ি সদরের বুক চিরে একটি ছড়া বা নদী বয়ে গেছে, যার দুই পাড়ে নল খাগড়ার বন বিস্তৃত ছিল। এই বন থেকে ‘খাগড়াছড়ি’ নামটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া কথিত আছে, ‘খাগড়াছড়ি’ একটি নদীর নাম, যা ওই অঞ্চলে খাগড়া বন থাকার কারণে এমন নাম ধারণ করেছে।
সাধারণ তথ্যাবলি
খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৭ নভেম্বর ১৯৮৩ সালে। এই জেলার আয়তন ২,৭৪৯.১৬ বর্গ কিমি এবং ২০২২ সালের জনগণনার তথ্যমতে এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ৭,১৪,১১৯ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিমিতে ২৬০ জন এবং শিক্ষার হার ৭৪.৪%।
প্রশাসনিক কাঠামো
খাগড়াছড়ি জেলার প্রশাসনিক কাঠামো নিম্নরূপ:
- উপজেলা: ৯টি — সদর, দীঘিনালা, পানছড়ি, মহালছড়ি, মাটিরাঙ্গা, মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়ী, রামগড়, এবং গুইমারা।
- পৌরসভা: ৩টি।
- ইউনিয়ন: ৩৮টি।
- সংসদীয় আসন: ১টি।
- প্রধান নদনদী: ফেনী ও মাইনী।
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং পর্যটন কেন্দ্রসমূহ
খাগড়াছড়ির সৌন্দর্য এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্থান হলো:
আলুটিলা গুহা
আলুটিলা গুহা, বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির আরবারী পাহাড়ে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক গুহা, যা আলুটিলা রহস্যময় গুহা নামেও পরিচিত। স্থানীয়দের মতে, এটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে, এবং এটি দেখতে প্রতিদিন বহু পর্যটক আসে। গুহাটি সরু এবং অন্ধকার, যা আগন্তুকদের মাঝে ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে।
রিছাং ঝর্ণা
রিছাং ঝর্ণা বা সাপমারা রিছাং ঝর্ণা খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার সাপমারা গ্রামে অবস্থিত। এই ঝর্ণার নামটি এসেছে মারমা ভাষার শব্দ রিং, যার অর্থ পানি, এবং ছাং, যার অর্থ উঁচু স্থান থেকে ঝরে পড়া। এটির শান্ত পরিবেশ এবং সৌন্দর্য পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
নিউজিল্যান্ড পাড়া
নিউজিল্যান্ড পাড়া খাগড়াছড়ি সদরে অবস্থিত একটি মনোরম স্থান। পানখাইয়া পাড়া এবং পোরাছড়ার কিছু অংশ নিউজিল্যান্ডের মতো দেখতে হওয়ায় স্থানীয়দের কাছে এটি নিউজিল্যান্ড পাড়া নামে পরিচিত। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং গ্রামাঞ্চলের অনন্য রূপ পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
মুক্তিযুদ্ধ এবং খাগড়াছড়ি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও খাগড়াছড়ি জেলার বিশেষ অবদান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই জেলার বিভিন্ন অংশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করা হয়েছিল। বিভিন্ন তারিখে বিভিন্ন উপজেলায় হানাদার মুক্ত দিবস পালন করা হয়:
- ৬ ডিসেম্বর: লক্ষ্মীছড়ি
- ৮ ডিসেম্বর: রামগড়
- ১২ ডিসেম্বর: পানছড়ি
- ১৪ ডিসেম্বর: দীঘিনালা
- ১৫ ডিসেম্বর: সদর, গুইমারা, মাটিরাঙ্গা
- ১৬ ডিসেম্বর: মানিকছড়ি, মহালছড়ি
দর্শনীয় স্থানসমূহ
খাগড়াছড়ির বিভিন্ন উপজেলা এবং এলাকায় ছড়িয়ে থাকা বেশ কিছু পর্যটন এবং ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, যেমন:
- সদর: জেলা পরিষদ পার্ক, পর্যটন মোটেল, এবং পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র।
- দীঘিনালা: তুষার ফ্রুটস ভ্যালি, বন বিহার।
- পানছড়ি: মায়াবিনী পর্যটন লেক, শান্তিপুর অরণ্য কুটির।
- লক্ষ্মীছড়ি: চিজুরানি লেক এবং শিলাছড়ি প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ।
- মহালছড়ি: ক্যাপ্টেন কাদের সরণী এবং ধুমনী ঘাট।
- রামগড়: কালাডেবা সুইচ গেট এবং মহামুনি বৌদ্ধ বিহার।
- মাটিরাঙ্গা: আলুটিলা গুহা, ভগবান টিলা, এবং শতবর্ষী বটগাছ।
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব
খাগড়াছড়ি জেলার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন:
- কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা: সাবেক সংসদ সদস্য এবং রাজনীতিবিদ।
- যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা: সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি জটিলতা নিরসন সম্পর্কিত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান।
- ওয়াদুদ ভূইয়া: সাবেক সংসদ সদস্য এবং রাজনীতিবিদ।
- নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা: পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা।
- সাচিংপ্রু চৌধুরী (মং রাজা): খাগড়াছড়ি জেলার রাজা।
- প্রভাংশু ত্রিপুরা: লেখক এবং গবেষক।
- শেফালিকা ত্রিপুরা: বিশিষ্ট সমাজসেবী এবং নারী উন্নয়ন কর্মী।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক গুরুত্ব, এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ খাগড়াছড়ি জেলা শুধু পর্যটনের জন্য নয়, গবেষণার জন্যও অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা পর্যটকদের কাছে পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণের নতুন অভিজ্ঞতা প্রদান করে এবং দেশের পর্যটন শিল্পে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
FAQs on খাগড়াছড়ি জেলা
প্রশ্ন: খাগড়াছড়ি জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিরা কারা?
উত্তর: জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চুক্তির প্রবক্তা), বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ঊষাতন তালুকদার প্রমুখ।
প্রশ্ন: খাগড়াছড়ি জেলার উপজেলা সমূহ কী কী?
উত্তর: খাগড়াছড়ি সদর, রামগড়, লক্ষীছড়ি, মাটিরাঙ্গা, পানছড়ি, দীঘিনালা, মানিকছড়ি, মহালছড়ি, এবং গুইমারা।
প্রশ্ন: খাগড়াছড়ি জেলার ইউনিয়ন সমূহ কী?
উত্তর: খাগড়াছড়ি জেলায় ৩৭টি ইউনিয়ন রয়েছে।
প্রশ্ন: খাগড়াছড়ি পূর্ব নাম কী ছিল?
উত্তর: খাগড়াছড়ি জেলার পূর্ব নাম ছিল “ত্রিপুরা হিল ট্র্যাক্টস।”
প্রশ্ন: খাগড়াছড়ি জেলার মানচিত্র কোথায় পাওয়া যাবে?
উত্তর: খাগড়াছড়ি জেলার মানচিত্র স্থানীয় প্রশাসনিক অফিস বা অনলাইনে জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন: খাগড়াছড়ি জেলার বর্তমান এমপি কে?
উত্তর: খাগড়াছড়ি জেলার বর্তমান এমপি হলেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।
প্রশ্ন: খাগড়াছড়ি জেলার বিখ্যাত খাবার কী?
উত্তর: বাঁশ কোড়ল, চাকমা পিঠা, পার্বত্য অঞ্চলের বিশেষ ভর্তা এবং দেশীয় মদ।
প্রশ্ন: খাগড়াছড়ি কিসের জন্য বিখ্যাত?
উত্তর: খাগড়াছড়ি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চেঙ্গি নদী, রিছাং ঝর্ণা, আলুটিলা গুহা, এবং পার্বত্য ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত।