ধাতু কি? ধাতু কত প্রকার ও কি কি? বাংলা ব্যকরণ। Class 6 to HSC

ধাতু: বাংলা ব্যাকরণের মূল উপাদান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণে ধাতু একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি ক্রিয়ার সেই মূল অংশ যা বাক্যে ক্রিয়ার ভাব প্রকাশের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ধাতু থেকে ক্রিয়াপদ গঠিত হয় এবং এটি ব্যাকরণ ও বাক্য গঠনের একটি অপরিহার্য উপাদান। এখানে ধাতুর পরিচয়, প্রয়োজনীয়তা, শ্রেণিবিভাগ এবং বাংলা ভাষায় এর বিশদ বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।
ধাতুর পরিচয়
ধাতু হলো ক্রিয়াপদের সেই মৌলিক অংশ যা কোনো বিভক্তি ছাড়া পাওয়া যায়। এটি মূলত ক্রিয়ার অর্থ প্রকাশ করে এবং বাক্যে ভাব প্রকাশের মূল ভিত্তি। যেমন: “পড়ছে” শব্দে “পড়” হলো ধাতু এবং “ছে” হলো বিভক্তি।
সংজ্ঞা:
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে বলেছেন:
“ক্রিয়াপদকে বিশ্লেষণ করিলে যে অবিভাজ্য মৌলিক অংশ পাওয়া যায়, যাহার দ্বারা ক্রিয়াপদের অন্তর্নিহিত ভাবটি মাত্র দ্যোতিত হয়, তাহাকে ক্রিয়া-প্রকৃতি বা ধাতু বলে।”
উদাহরণ:
- পড়ছে = পড় + ছে
- পড়ি = পড় + ই
- পড়ব = পড় + ব
প্রত্যেক ক্ষেত্রে “পড়” অংশটি ধাতু। ধাতুকে চিহ্নিত করতে √ চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন: √পড়।
ধাতু শব্দটি বাংলা ভাষায় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, যা ছাড়া বাক্য সম্পূর্ণ হয় না। এটি ভাষার শক্তি এবং সৌন্দর্যের মূল অংশ।
ধাতুর প্রয়োজনীয়তা
১. বাক্য গঠনে ধাতুর ভূমিকা
ধাতু ছাড়া ক্রিয়াপদ তৈরি হয় না। বাক্য গঠনে ক্রিয়াপদের অপরিহার্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি বাক্যে সঠিক অর্থ প্রকাশের জন্য ক্রিয়াপদের সঠিক ব্যবহার আবশ্যক।
উদাহরণ:
- “তুমি বই পড়ছ।”
এখানে “পড়ছ” হলো ক্রিয়াপদ এবং “পড়” হলো এর ধাতু।
২. কৃদন্ত শব্দের গঠন
ধাতু কেবল ক্রিয়াপদ নয়, কৃদন্ত শব্দ তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণ:
- √কৃ → কৃত, কর্তব্য।
- √বাঁধ → বাঁধন, বাধা।
৩. ভাষার পূর্ণতা
সমাপিকা ক্রিয়া ছাড়া বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ হয় না। ধাতু ক্রিয়া গঠনে সাহায্য করে এবং ভাষার পরিপূর্ণতা নিশ্চিত করে।
৪. ব্যাকরণগত নিয়মের ভিত্তি
ধাতু ভাষার ক্রিয়া সংক্রান্ত নিয়মের ভিত্তি। এটি বাংলা ভাষার ক্রিয়া এবং বাক্যের গঠনকে নিয়মতান্ত্রিক করে তোলে।
ধাতুর শ্রেণি বিভাগ
ধাতুর উৎপত্তি এবং প্রকৃতি অনুসারে এটিকে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে:
১. মৌলিক ধাতু
যেসব ধাতুকে বিশ্লেষণ করা যায় না এবং যা মূল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেগুলোকে মৌলিক ধাতু বলে।
উদাহরণ:
- কর্, পড়্, দেখ্, চল্।
এগুলোকে সিদ্ধ বা স্বয়ংসিদ্ধ ধাতু বলা হয়।
২. সাধিত ধাতু
মৌলিক ধাতুর সঙ্গে “আ” প্রত্যয় যোগ করে যে ধাতু গঠিত হয়, তাকে সাধিত ধাতু বলে।
উদাহরণ:
- পড়্ + আ = পড়া।
- ঘুম্ + আ = ঘুমা।
৩. সংযোগমূলক ধাতু
বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বনাত্মক শব্দের সঙ্গে ধাতু যোগ করে যে নতুন ধাতু তৈরি হয়, তাকে সংযোগমূলক ধাতু বলে।
উদাহরণ:
- লজ্জা + কর = লজ্জাকর।
- বড় + হ = বড় হ।
মৌলিক ধাতুর শ্রেণি বিভাগ
মৌলিক ধাতুকে আরও তিনটি উপশ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে:
১. বাংলা ধাতু
যেসব ধাতু প্রাকৃত ভাষা থেকে পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলোকে বাংলা ধাতু বলে।
উদাহরণ:
- আঁক, কাট, জান।
২. সংস্কৃত ধাতু
তৎসম ধাতু, যা সরাসরি সংস্কৃত থেকে এসেছে।
উদাহরণ:
- কৃ, ধৃ, পঠ।
তুলনামূলক উদাহরণ:
| সংস্কৃত ধাতু | গঠিত পদ | বাংলা ধাতু | গঠিত পদ |
|—————|————|————–|————|
| কৃ | কৃত, কর্তব্য | কাট | কাটা |
| পঠ | পঠন, পাঠ্য | পড় | পড়া |
৩. বিদেশি ধাতু
যেসব ধাতু বিদেশি ভাষা থেকে এসেছে।
উদাহরণ:
- হিন্দি: খাট, ঝুল।
- আরবি-ফারসি: ফির, চাহ।
সাধিত ধাতুর শ্রেণি বিভাগ
সাধিত ধাতুকে গঠনরীতি ও অর্থের ভিত্তিতে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
১. নামধাতু
বিশেষ্য বা বিশেষণের সঙ্গে “আ” যোগ করে যে ধাতু গঠিত হয়।
উদাহরণ:
- ঘুম + আ = ঘুমা।
- চমক + আ = চমকা।
২. প্রযোজক ধাতু
মৌলিক ধাতুর সঙ্গে প্রেরণা অর্থে “আ” যোগ করে গঠিত।
উদাহরণ:
- পড়্ + আ = পড়া (পড়ানো)।
- কর্ + আ = করা (করানো)।
৩. কর্মবাচ্যের ধাতু
কর্ম অনুসারে ক্রিয়ার ধাতু।
উদাহরণ:
- খা + আ = খাওয়া।
- দেখ্ + আ = দেখা।
সংযোগমূলক ধাতুর শ্রেণি বিভাগ
সংযোগমূলক ধাতু তৈরি হয় বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বনাত্মক শব্দের সঙ্গে ধাতু যুক্ত করার মাধ্যমে।
উদাহরণ:
- লজ্জা + কর = লজ্জাকর।
- বড় + হ = বড় হ।
- টের + পা = টের পা।
ধাতুর গণ
বাংলা ভাষার ধাতুকে বানানের ধরন অনুযায়ী ২০টি গণে ভাগ করা হয়েছে।
গণ নির্ধারণের ধাপ:
- ধাতুটি কয়টি অক্ষরে গঠিত।
- ধাতুর প্রথম বর্ণে কোন স্বরবর্ণ যুক্ত।
উদাহরণ:
- হ-আদিগণ: হওয়া।
- খা-আদিগণ: খাওয়া।
- লাফা-আদিগণ: লাফানো।
বিভিন্ন ধাতুর গণ:
গণ | উদাহরণ |
---|---|
হ-আদিগণ | হওয়া |
খা-আদিগণ | খাওয়া |
উল্টা-আদিগণ | উল্টানো |
উপসংহার
ধাতু বাংলা ভাষার একটি অপরিহার্য উপাদান। এটি ক্রিয়াপদ গঠনের মূল ভিত্তি এবং ভাষার গঠন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ধাতুর বিভিন্ন শ্রেণি এবং বৈচিত্র্য বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। সঠিকভাবে ধাতুর ব্যবহার ভাষার ভাব প্রকাশকে স্পষ্ট ও সুস্পষ্ট করে তোলে। ধাতুর উপর ভিত্তি করেই বাংলা ভাষা তার নিজস্ব গৌরব ও স্বকীয়তা বজায় রেখেছে।