ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিচিতি। Brahman Baria District

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বাংলাদেশে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ জেলার ভূমিকা এবং এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উল্লেখযোগ্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল পূর্বে কুমিল্লা জেলার অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু ১৯৮৪ সালে এটি পৃথক জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই জেলার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, যা স্থানীয় সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের অবদান, এবং এর বিশিষ্ট স্থান ও ব্যক্তিত্বদের কারণে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পটভূমি
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পূর্বে কুমিল্লা জেলার অংশ ছিল। ১৭৯৩ সালে ত্রিপুরা জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ অংশ ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৩০ সালে সরাইল, দাইদপুর, হরিপুর, বেজুরা, এবং সতেরখন্দল অঞ্চল ত্রিপুরা জেলায় যুক্ত হয়। পরবর্তীতে ১৮৭৫ সালে নাসিরনগর মহকুমা নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা করা হয়, এবং ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এটি মহকুমা হিসেবেই পরিচিত ছিল। অবশেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ সালে এটি বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিসেবে গঠিত হয়।
নামকরণ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণ নিয়ে কিছু কিংবদন্তী রয়েছে। সেন বংশের রাজত্বকালে রাজা লক্ষণ সেন তার রাজত্বের সময় অভিজাত ব্রাহ্মণকুলের অভাব পূরণ করতে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে নিয়ে আসেন এবং তাদের বাড়ির অবস্থান থেকেই এ জেলার নামকরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া করা হয়। যদিও এই নামের প্রচলিত বিকৃত রূপ ‘বি-বাড়িয়া’ ব্যবহার করা হত, তবে ২০২২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই বিকৃত নাম ব্যবহারের পরিবর্তে ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামটি সর্বক্ষেত্রে ব্যবহারের নির্দেশ দেয়।
প্রশাসনিক কাঠামো
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রশাসনিক কাঠামোও গুরুত্বপূর্ণ। এটি ৯টি উপজেলায় বিভক্ত: সদর, কসবা, নাসিরনগর, সরাইল, আশুগঞ্জ, আখাউড়া, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, এবং বিজয়নগর। এর মধ্যে ৯টি থানা, ৫টি পৌরসভা এবং ১০০টি ইউনিয়ন রয়েছে। জেলা পরিষদের সাথে মিলিত সংসদীয় আসন রয়েছে ৬টি।
ভৌগোলিক বিবরণ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আয়তন ১,৮৮১.২০ বর্গ কিমি, যা দেশের ৩৬তম বৃহৎ জেলা হিসেবে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেশের ১৩তম স্থান এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৪র্থ স্থান অধিকার করে। এখানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নদী প্রবাহিত হয়েছে, যেমন—তিতাস, মেঘনা, পুটিয়া, বিজনা, বুড়ি, মধ্যগঙ্গা, হরল, বড়ইচারা, লাখ, সিংরা ইত্যাদি।
জনসংখ্যা ও শিক্ষার হার
২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ লক্ষ ৬ হাজার ৫৬৩ জন। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই জেলার অবস্থান উন্নত, যেখানে স্বাক্ষরতার হার প্রায় ৭৩.৭% (SVRS 2023)।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অবদান অসাধারণ। এ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল এবং এখানে বেশ কিছু শত্রুমুক্ত দিবসও রয়েছে। নাসিরনগর ৭ নভেম্বর, বিজয়নগর ৩০ নভেম্বর, কসবা ২ ডিসেম্বর, আখাউড়া ৬ ডিসেম্বর, সদর ও সরাইল ৮ ডিসেম্বর, আশুগঞ্জ ১০ ডিসেম্বর, নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুর ১৪ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়।
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
কবি আল মাহমুদ
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীতে দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করা তাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত, যিনি পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
প্রধান দর্শনীয় স্থান
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
- তিতাস গ্যাসক্ষেত্র (সদর)
- আখাউড়া স্থল বন্দর এবং বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কবর (আখাউড়া)
- নবীনগর জমিদার বাড়ি (নবীনগর)
- জয়কুমার জমিদার বাড়ি এবং হরিপুর বড়বাড়ি (নাসিরনগর)
- মেঘনা নদীর পার এবং আশুগঞ্জ সারকারখানা (আশুগঞ্জ)
- কালাছড়া এবং হরিহর টি এস্টেট (বিজয়নগর)
স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও উল্লেখযোগ্য। মিষ্টির মধ্যে “ছানামুখী মিষ্টি” এই জেলার এক বিশেষ মিষ্টান্ন, যা ২০২৪ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ঐতিহাসিক ঘটনাবলী
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। বিভিন্ন সময়ে এটি সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় এ জেলার মানুষ সাহসিকতার পরিচয় দেয়। এছাড়া এখানে অনেক ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনা রয়েছে যা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
উপসংহার
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানকার মানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে।
FAQ: বি বাড়িয়া জেলা
প্রশ্ন: বি বাড়িয়া জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিরা কারা?
উত্তর: উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল, নবীন চন্দ্র সেন প্রমুখ।
প্রশ্ন: বি বাড়িয়া জেলার ইউনিয়ন কয়টি?
উত্তর: বি বাড়িয়া জেলায় মোট ৯৯টি ইউনিয়ন রয়েছে।
প্রশ্ন: বি বাড়িয়া জেলার বিখ্যাত স্থান কী কী?
উত্তর: তিতাস নদী, নবীনগর, উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, মাজার শরীফ ইত্যাদি।
প্রশ্ন: বি বাড়িয়া জেলার পূর্ব নাম কী?
উত্তর: ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
প্রশ্ন: বি বাড়িয়া জেলার থানাগুলো কী কী?
উত্তর: ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, আশুগঞ্জ, কসবা, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুরসহ মোট ৯টি থানা।
প্রশ্ন: বি বাড়িয়া জেলার জনসংখ্যা কত?
উত্তর: আনুমানিক ২৮ লক্ষাধিক।