বাংলা একাডেমি ইতিহাস ও পরিচিতি। Bangla Academy

বাংলা একাডেমি: ৭০ বছরে পদার্পণ
২০২৪ সালের ৩ ডিসেম্বর, বাংলা একাডেমি তার প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পূর্ণ করবে। এই দীর্ঘ যাত্রায় বাংলা একাডেমি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে অবদান রেখেছে। একাডেমির ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ আমরা এক নজরে দেখবো বাংলা একাডেমির ইতিহাস, কাঠামো এবং তার অনন্য অবদান।
পটভূমি
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই বাঙালির জাতিসত্তা ও মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় এক নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের আত্মবলিদানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়।
এ সময়, যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ১৬ নম্বর ধারায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা, উন্নয়ন এবং প্রচারের জন্য একটি গবেষণাগারের প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়। এর ফলস্বরূপ ১৯৫৫ সালের ২৬ নভেম্বর বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠার জন্য ‘আয়োজক সমিতি’ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে, ১৯৫৬ সালে বাংলা একাডেমি কার্যক্রম শুরু করে এবং ১৯৫৭ সালে এটি আইনি ভিত্তি পায়।
বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা
১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রথম অবস্থায় একাডেমির সদর দপ্তর ছিল বর্ধমান হাউসে, যা ঢাকার ঐতিহাসিক একটি ভবন। এটি মোগল এবং ইউরোপীয় শৈলীতে নির্মিত একটি স্থাপনা, যা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর নির্মিত হয়। এই ভবনটি এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের বাসভবন হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। একাডেমি প্রতিষ্ঠার পরপরই এর বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও প্রসারিত করা হয়।
একাডেমির কাঠামো এবং বিভাগসমূহ
বাংলা একাডেমির বর্তমান কাঠামো বেশ বিস্তৃত। একাডেমির ৮টি প্রধান বিভাগ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গবেষণা, অনুবাদ, পাঠ্যপুস্তক, সংকলন, গ্রন্থাগার, ফোকলোর, জাদুঘর, এবং প্রশাসনিক কাজ। এই বিভাগগুলো একাডেমির বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
একাডেমির প্রধান উদ্দেশ্য হলো বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির গবেষণা এবং উন্নয়ন করা। পাশাপাশি, এটি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাংলা একাডেমির বর্তমান অবস্থা
বাংলা একাডেমি এখন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়, যার প্রধান নির্বাহী হলেন মহাপরিচালক। বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজম। একাডেমির সভাপতি হচ্ছেন আবুল কাসেম ফজলুল হক। একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে ভাষা ও সাহিত্য গবেষণা, অনুবাদ, আন্তর্জাতিক সাহিত্য মেলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের আয়োজন।
বাংলা একাডেমির ভবিষ্যত
বাংলা একাডেমি তার ৭০ বছর পূর্তিতে সামনে আরো এক নতুন দিগন্তের দিকে তাকিয়ে। একাডেমি আরও শক্তিশালী ও আধুনিক গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। এটি কেবল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যই নয়, বরং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং জাতিগত গৌরবকে সারা পৃথিবীতে তুলে ধরবে।
আজকের দিনে বাংলা একাডেমি আমাদের ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, এমনটাই প্রত্যাশা।
বাংলা একাডেমি সম্পর্কে কিছু তথ্য:
- প্রতিষ্ঠা: ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৫
- ধরণ: স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান
- উদ্দেশ্য: বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গবেষণা, প্রকাশনা, অনুবাদ এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানভিত্তিক জাতি গঠন
- সদর দপ্তর: বর্ধমান হাউস, ঢাকা
- বর্তমান মহাপরিচালক: অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজম
- বর্তমান সভাপতি: আবুল কাসেম ফজলুল হক
- প্রথম মহাপরিচালক: অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম
- ওয়েবসাইট: banglaacademy.gov.bd
অমর একুশে বইমেলা
‘বইমেলা’ বা ‘গ্রন্থমেলা’ শব্দ দুটি আমাদের কাছে এক বিশেষ অর্থ বহন করে, যা আমাদের চোখের সামনে অবধারিতভাবে ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলার দৃশ্য। ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় এক টুকরো চটের উপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার সূচনা করেন। এরপর ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মহান একুশে মেলা উপলক্ষে ১৫-২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। ১৯৭৫ সালে একাডেমি মাঠের কিছু জায়গায় চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য স্টল নির্দিষ্ট করা হয়, যা ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। পরবর্তী সময়ে, ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বইমেলাকে একাডেমির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি, যা চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকেই প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে মেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে, যা ১৯৮৪ সাল থেকে নিয়মিতভাবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জীবিত লেখকদের মৌলিক অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬০ সাল থেকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করছে। বাংলা সাহিত্যের ১০টি শাখায় এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রতিটি পুরস্কারের মূল্যমান ৩,০০,০০০ টাকা।
অন্যান্য পুরস্কার
বাংলা একাডেমি বিভিন্ন বিশেষ পুরস্কারও প্রদান করে, যেমন:
- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার (২০১৪), ৫০ হাজার টাকা
- রবীন্দ্র পুরস্কার (২০১০), ১ লাখ টাকা
- কবীর চৌধুরী শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০০৪), ১ লাখ টাকা
- মেহের কবীর বিজ্ঞান সাহিত্য পুরস্কার (২০০৫), ১ লাখ টাকা
- মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার (২০১৯), ২ লাখ টাকা
- সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭), ১ লাখ টাকা
এছাড়া বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকরা ফেলো হিসেবে পরিচিত হন। প্রতি বছর একাডেমি দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে, যাতে তাদের বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
প্রকাশিত পত্রিকা
বাংলা একাডেমি নানা ধরনের পত্রিকা প্রকাশ করে:
- উত্তরাধিকার (মাসিক), ১৯৭৩
- ধানশালিকের দেশ (ত্রৈমাসিক), ১৯৭৩
- বাংলা একাডেমি বিজ্ঞান পত্রিকা (ষান্মাসিক), ১৯৭৪
- বাংলা একাডেমি পত্রিকা (ত্রৈমাসিক), ১৯৫৭
- বাংলা একাডেমি ফোকলোর পত্রিকা (ষান্মাসিক), ২০১৯
মোদের গরব
বাংলা একাডেমি ভবনের সামনে ‘মোদের গরব’ নামক একটি ভাস্কর্য স্থাপিত রয়েছে, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে নির্মিত। এই ভাস্কর্যটির নকশা ও নির্মাণ করেন ভাস্কর শিল্পী অখিল পাল। ২০০৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এটি উদ্বোধন করা হয়।
নজরুল মঞ্চ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে বাংলা একাডেমির ঐতিহাসিক বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে নজরুল মঞ্চ অবস্থিত।
রবীন্দ্র চত্বর
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের পূর্ব দিকে অবস্থিত রবীন্দ্র চত্বর।
ভাষা-শহীদ মুক্তমঞ্চ
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে বাংলা একাডেমির পুকুরের পশ্চিম পাড়ে ভাষা-শহীদ মুক্তমঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে।
ভাষা আন্দোলন জাদুঘর
বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের নিচতলায় অবস্থিত ভাষা আন্দোলন জাদুঘর, যা ১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ উদ্বোধন করা হয়। এটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং সংরক্ষিত স্মৃতিসমূহ প্রদর্শন করে।
লোকঐতিহ্য জাদুঘর
বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের তৃতীয় তলায় অবস্থিত লোকঐতিহ্য জাদুঘর ২০২০ সালে প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
FAQ’s on বাংলা একাডেমি
১. বাংলা একাডেমির বর্তমান চেয়ারম্যানের নাম কী?
বাংলা একাডেমির বর্তমান চেয়ারম্যান হলেন মাহফুজুল হক।
২. বাংলা একাডেমির বর্তমান চেয়ারম্যান কে?
বাংলা একাডেমির বর্তমান চেয়ারম্যান হলেন মাহফুজুল হক।
৩. একাডেমি কে কবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?
বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর।
৪. বাংলা একাডেমি কি সরকারি?
হ্যাঁ, বাংলা একাডেমি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে।