থ্রি জিরো তত্ত্ব গড়বে নতুন বিশ্ব। জানতে চাই 3 zero Theory

২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার নতুন তত্ত্ব থ্রি জিরো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, এ তত্ত্ব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং একটি সমতাভিত্তিক টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলার নতুন দিশা দিতে সক্ষম। পরে ১৩ নভেম্বর ২০২৪, কপ ২৯ জলবায়ু সম্মেলনে তিনি এই তত্ত্ব আরও বিশদভাবে তুলে ধরেন।
থ্রি জিরো তত্ত্ব: একটি বৈপ্লবিক ধারণা
থ্রি জিরো বা তিন শূন্য তত্ত্ব একটি নতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত, কর্মসংস্থানমুখী এবং পরিবেশবান্ধব করার পরিকল্পনা প্রস্তাব করে। ড. ইউনূস এই তত্ত্বের মাধ্যমে নতুন এক সভ্যতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যেখানে সমাজ, অর্থনীতি এবং পরিবেশ একত্রে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
থ্রি জিরো তত্ত্ব
থ্রি জিরো তত্ত্ব তিনটি মূল লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে:
- শূন্য দারিদ্র্য (Zero Poverty):
ড. ইউনূস দারিদ্র্যকে মানবসৃষ্ট একটি সমস্যা হিসেবে দেখেন। তার মতে, সম্পদের অসম বণ্টন দারিদ্র্যের মূল কারণ। তিনি বিশ্বাস করেন, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব। তার প্রবর্তিত মাইক্রোফাইন্যান্স উদ্যোগ, বিশেষত গ্রামীণ ব্যাংক, দরিদ্রদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এখানে মুনাফার চেয়ে মানুষের কল্যাণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। - শূন্য বেকারত্ব (Zero Unemployment):
তিনি বলেন, প্রতিটি মানুষই উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা রাখে। যদি তাদের প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ এবং সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া যায়, তাহলে তারা নিজেরাই কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে। এভাবে বেকারত্ব দূর হবে এবং কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। - শূন্য নিট কার্বন নির্গমন (Zero Net Carbon Emissions):
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে ড. ইউনূস পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, কার্বন নির্গমন কমাতে সবুজ প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
থ্রি জিরো বাস্তবায়নে চারটি মহাশক্তি
ড. ইউনূস মনে করেন, থ্রি জিরো লক্ষ্য অর্জনের জন্য চারটি প্রধান শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে:
- তরুণদের শক্তি ও সৃজনশীলতা ব্যবহার করা।
- প্রযুক্তির শক্তিকে কাজে লাগানো।
- ব্যবসাকে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করা।
- সুশাসন নিশ্চিত করা।
টেকসই উন্নয়ন ও থ্রি জিরো
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) বাস্তবায়নে থ্রি জিরো একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে SDG অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে।
ড. ইউনূসের মতে, তরুণদের ক্ষমতায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। থ্রি জিরো তত্ত্ব কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটানোর পাশাপাশি শিল্প খাতেও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
প্যারিস অলিম্পিকে থ্রি জিরো
২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকে থ্রি জিরো তত্ত্বের দারুণ প্রতিফলন দেখা যায়। অলিম্পিকের আয়োজন পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের ওপর ভিত্তি করে করা হয়। যেমন:
- প্যারিসের অনুন্নত অঞ্চল সেইন্ট ডেনিস-এ মূল আয়োজন করা হয়।
- স্টেডিয়ামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের বাড়তি ব্যবস্থা না রেখে পরিবেশবান্ধব ডিজাইন ব্যবহার করা হয়।
- কার্বন মিশ্রিত কংক্রিটের পরিবর্তে কাঠের ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর।
পোপ ফ্রান্সিস-ইউনূস থ্রি জিরো ক্লাব
২০২৪ সালে রোমে ড. ইউনূস এবং পোপ ফ্রান্সিস একত্রে পোপ ফ্রান্সিস-ইউনূস থ্রি জিরো ক্লাব চালু করেন। এ ক্লাবের উদ্দেশ্য হলো, মানবতার জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ৪,৬০০টিরও বেশি থ্রি জিরো ক্লাব রয়েছে, যা ড. ইউনূসের ধারণায় অনুপ্রাণিত।
থ্রি জিরো তত্ত্বের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ড. ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্ব শুধুমাত্র একটি তত্ত্ব নয়; এটি একটি বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা সমগ্র বিশ্বের দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশগত সমস্যার সমাধানে দিকনির্দেশনা দেয়। এটি ভবিষ্যতে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে আরও বৃহৎ পরিসরে আলোচিত হবে এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিশ্বকে সমতাভিত্তিক এবং টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিতে ড. ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্ব একটি অনন্য উদাহরণ। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য একটি নতুন সভ্যতার পথপ্রদর্শক।