মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুরু থেকে শেষ। Current Affairs update

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একাত্তরের প্রতিটি দিনই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা রক্তের অক্ষরে লেখা। তবে কিছু কিছু তারিখ সংগ্রামের গৌরব, ত্যাগ এবং বিজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় হিসেবে চিহ্নিত। এই ব্লগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলো নিয়ে সাজানো হয়েছে একটি টাইমলাইন।
২ মার্চ-২৫ মার্চ: অসহযোগ আন্দোলন (December current affairs)
১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তীব্র অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে স্বশাসন প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করে সাধারণ জনগণ। অসহযোগ আন্দোলন ছিল আমাদের স্বাধীনতার যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ।
২ মার্চ: স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্রনেতা আ. স. ম. আবদুর রব। এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম প্রতীক, যা স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরু এবং জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
৩ মার্চ: স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা
শাজাহান সিরাজ পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দাবিগুলি নির্ধারিত হয়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরও তীব্র করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ হন শঙ্কু সমজদার, রংপুর থেকে, যিনি স্বাধীনতার প্রথম তরুণ শহীদ হিসেবে চিহ্নিত।
৭ মার্চ: ঐতিহাসিক ভাষণ
৭ই মার্চ, ১৯৭১, ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়া হয়। এটি ছিল জাতির উদ্দেশে তাঁর বিখ্যাত ভাষণ, যেখানে তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন। এই ভাষণ ছিল বাংলাদেশ স্বাধীনতার পথে একটি শক্তিশালী কন্ঠস্বর এবং এটি জাতীয় চেতনায় নবজাগরণের সূচনা করে।
১৯ মার্চ: মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ
গাজীপুরের জয়দেবপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্য এবং সাধারণ জনগণ প্রথমবার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র সংঘর্ষ।
২৫ মার্চ: অপারেশন সার্চ লাইট
২৫ মার্চ, পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ শুরু করে। এটি ছিল এক ভয়াবহ গণহত্যার সূচনা। পাকিস্তানি বাহিনী রাত্রির আঁধারে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালায়, যা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। এর ফলে বহু নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্মরণ করা হয়।
২৬ মার্চ: স্বাধীনতা ঘোষণা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্মদিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেটি সারা জাতির জন্য নতুন আশার আলোর পথ দেখিয়েছিল।
৪ এপ্রিল: তেলিয়াপাড়া সভা
তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে মুক্তিবাহিনী গঠনের জন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ এবং সাধারণ সশস্ত্র জনগণকে একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধ চালানোর জন্য একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করা হবে। কর্নেল ওসমানী এই বাহিনীর প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন।
১০ এপ্রিল: প্রথম সরকার গঠন
১০ এপ্রিল, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয়। ছয় সদস্যের সরকার গঠনের পাশাপাশি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও জারি করা হয়। এটি ছিল আমাদের স্বাধীনতার প্রথম সরকার, যা আমাদের ভবিষ্যত পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করে।
১১ এপ্রিল: প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ভাষণ
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণ দেন, যেখানে তিনি সমগ্র দেশকে ৮টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করার ঘোষণা দেন। এই পরিকল্পনা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন ও পরিচালনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
১৭ এপ্রিল: প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ
মুজিবনগর, বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। তাজউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বে এই সরকার দেশের অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে মুজিবনগরকে ঘোষণা করে।
৬ ডিসেম্বর: যশোর প্রথম পাক হানাদার মুক্ত
৬ ডিসেম্বর, প্রথম বৃহত্তর যশোর জেলা পাক হানাদার মুক্ত হয়। এই দিনেই বাংলাদেশ প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়, যখন ভুটান প্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
১৪ ডিসেম্বর: শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের সময়, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী মহল ১৪ ডিসেম্বর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এই দিনটি শোকাবহ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৬ ডিসেম্বর: বিজয় লাভ
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত দিন ১৬ ডিসেম্বর, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তির সূচনা এবং একটি নতুন জাতির উন্মেষের দিন।
স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সংরক্ষণ
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চিরকাল স্মরণীয় রাখতে বিভিন্ন স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মিত হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এটি মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের এক মহিমান্বিত স্মৃতি হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। এছাড়াও ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত স্বাধীনতা জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, এবং বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস চিত্রিত করে।
এই সমস্ত স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অমূল্য ধারক হিসেবে কাজ করছে, যাতে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে জানার সুযোগ পায়।